জুম চাষ কি ও কেন করা হয় জানতে বিস্তারিত পড়ুন
ড্রাগন ফল চাষ করার পদ্ধতি প্রিয় পাঠক, আজকে আমরা জুম চাষ কি, জুম চাষ কেন করা হয় ও জুম চাষ পদ্ধতি সহ জুম চাষ সম্পর্কে আরো অনেক তথ্য বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করব। জুম চাষ সম্পর্কে হয়তো অনেকেই আমরা জানিনা।
তাছাড়া আজকাল জুম চাষ সম্পর্কে বিভিন্ন শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে উল্লেখ করা রয়েছে।
চতুর্থ শ্রেণী থেকে নবম দশম শ্রেণীর ভূগোল ও পরিবেশ বইয়ে জুম চাষ সম্পর্কে অনেক
তথ্যই দেয়া হয়েছে কিন্তু সম্পূর্ণরূপে উল্লেখ করা হয়নি। তাই জুম চাষ সম্পর্কে
জানতে অবশ্যই সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়ুন।
সূচিপত্রঃ
ভূমিকা
জুম চাষ বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলে করা হয়। জুম চাষের ইতিহাস হাজারো বছর পুরনো।
বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চল চট্টগ্রাম, গারো ও খাসিয়া পাহাড় ইত্যাদি স্থানে এই
চাষ দেখা যায়।
আরো পড়ুন:ব্লুবেরি চাষ করে লাখ টাকা ইনকাম
তাছাড়া ভারতের আসাম ,মেঘালয় ,অরুনাচল, মিজোরাম ,ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড ,মনিপুর
এই সকল রাজ্যে ঝুম চাষ ব্যাপকভাবে পরিচিত। চীন,নেপাল, মিয়ানমার,ভিয়েতনাম,
থাইল্যান্ড সহ মঙ্গোলিয়ান পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে জুম চাষের ঐতিহ্য রয়েছে।
জুম চাষ কি?
জুম চাষ পাহাড়ি অঞ্চলের প্রচলিত কৃষি পদ্ধতি। জুম চাষকে অনেকেই ঝুম চাষ হিসেবেও
চিনে। জুম চাষ এক ধরনের স্থানান্তরিত চাষ পদ্ধতি। সাধারণত পাহাড়ের গাছ কেটে বা
বন উজাড় করে মাটি উর্বর রাখার জন্য এই চাষ করা হয়। আবার সেই স্থানের উর্বরতা
কমে গেলে জুম চাষের জন্য নতুন জায়গা তৈরি করা হয়।
এটি সাধারণত পাহাড়ের ঢালু বা সমতল জায়গায় করা হয়। ঝুম চাষ পাহাড়ি
নৃগোষ্ঠীদের জীবিকার প্রধান উৎস। এর মাধ্যমে বছরে বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন ধরনের
ফসল চাষ করা হয়। বছরের প্রায় বিশ হাজার হেক্টর জমিতে এ চাষ করা হয়। চাকমা ও
মারমা সমাজের মানুষের কাছে এই চাষ বিশেষ জনপ্রিয়।
পাহাড়ের মাটির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য জুন চাষ করা হয়। একই স্থানে তিন থেকে পাঁচ
বছর চাষ করা হয়। চাষ করার পর মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে নতুন জায়গায় স্থানান্তর
করা হয়। পাহাড়ের জঙ্গল উজাড় করে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করতে যে চাষ করা হয়
তাকে মূলত জুম চাষ বলা হয়। জুম চাষীদের জুমিয়f বলা হয়। এই চাষ ভারতে বিরা,পুরো
ও পুনম নামে পরিচিত।
জুম চাষের পদ্ধতি
জুম চাষ বহু পুরনো কৃষি পদ্ধতি। চাকমা, মারমা ও বিভিন্ন উপজাতিরা এই চাষ করে
থাকেন। জুম চাষে তারা বিভিন্ন ধরনের ফসল বছরে বিভিন্ন সময় করে থাকেন। জুম চাষ কে
ইংরেজিতে শিফটিং কাল্টিভেশন বলা হয়।পাহাড়ে বসবাসরত বিভিন্ন উপজাতি বা
নৃ-গোষ্ঠীরা জুম চাষের মাধ্যমে তারা জীবিকা নির্বাহ করে।চলুন তাহলে জুম চাষের
পদ্ধতি সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা যাক।
জমি নির্বাচন: জুম চাষের জন্য সাধারণত পাহাড়ের উঁচু ঢালু এবং সম্মত
জায়গা নেয়া হয়। পাহাড়ে থাকা বন উজাড় করে চাষ করা হয়। গাছপালা আগুনে
পুড়িয়ে ফেলার পর পোড়া ছাই কিছুদিন মাটির উপরেই রাখা হয়। এতে করে জমে উর্বরতা
কিছুটা বৃদ্ধি পায়। তিন থেকে পাঁচ বছর টানা ওই জমিতে জুম চাষ করা হয়।
জমি তৈরি: ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসের মধ্যে পাহাড়ের গাছ কেটে রোদে
শুকিয়ে ফেলে। গাছপালা সম্পূর্ণরূপে শুকনো হওয়ার পর এর মধ্যে আগুন ধরিয়ে দেয়া
হয়। গাছগুলোকে এমন ভাবে পোড়াতে হবে যাতে মাটির ভিতরেও কিছুটা অংশ পুড়ে
যায়।
এরপর এই পোড়া ছাই কিছুদিন মাটির উপরেই ফেলে রাখা হয়। বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করা
হয় এবং বৃষ্টিতে ছাইগুলো মাটির সাথে ভালোভাবে মিশে যায়।এতে করে মাটিটা আরো
উর্বর হয়ে যায়।
বীজ বপন ও ফসল চাষ: এপ্রিল ও মে মাসের মধ্যে জমিতে বীজ বপন করে। জুম
চাষে বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষ করা হয়। যেমন পেঁপে কলা শসা বরবটি ও বিভিন্ন
শাকসবজি। স্বল্প মেয়াদী ফল যেমন: পেপে পেয়ারা লেবু ইত্যাদি।তাছাড়া গম ভুট্টা ও
ধানও চাষ করা হয়। মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে এ সকল ফসলের বীজ বপন করা হয়।
এ সকল ফসল সংগ্রহ করার পর মৌসুমী ভিত্তিক ফসল যেমন: টমেটো, বেগুন ,ঢেড়স ইত্যাদিও
চাষ করা হয়। জুম চাষে বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষ করা হয়। বছরের প্রায় প্রতি মৌসুমে
পাওয়া ফল জুম চাষে করা হয়।এজন্য জুম চাষ সম্মিলিত ফলন চাষ হিসেবেও পরিচিত।
তাছাড়া জুম চাষের একটি অন্যতম ফসল হল ধনিয়া পাতা।
ফসল সংগ্রহ: জুম চাষে মূলত প্রতি মৌসুমে মৌসুমী ফল চাষ করা হয়। তাই
প্রতি মৌসুমে হিসাব রেখে তারা ফসল সংগ্রহ করে। ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাস জুম
চাষের ফসল সংগ্রহের বিশেষ সময়। তাই জুম চাষ হলো পাহাড়ি অঞ্চলের একটি ঐতিহ্য।
জুম চাষের পদ্ধতি অতি সহজ হলেও এর পিছনে পাহাড়ি আদিবাসী অনেক পরিশ্রম করে থাকে।
এই চাষের মাধ্যমে তারা তাদের জীবন অতিবাহিত করে।
জুম চাষের বৈশিষ্ট্য
জুম চাষকে স্থানান্তরিত চাষ বলা হয়। এই স্থানান্তরিত চাষ বা জুম চাষের কিছু
বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ:
- ক্ষেত্র ঘূর্ণন
- আগুন পৃথিবীকে পরিষ্কার করার কাজে ব্যবহৃত হয়।
- পুনর্জন্মের অনুমতি দেওয়ার জন্য জমিটি কয়েক বছর যাবত পতিত অবস্থায় পড়ে থাকে।
- প্রথম বর্ষার বৃষ্টির পর ছাইয়ে বীজ বপন করা, এরপর সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে ফসল তোলা।
- প্রাথমিক ইনপুট হিসাবে মানুষ শ্রম দিয়ে থাকে।
- কোন প্রকার প্রাণীর ব্যবহার করা হয় না।
- চাষ করার জন্য জঙ্গল পরিষ্কার করা প্রয়োজন।
জুম চাষের ক্ষতিকর প্রভাব
জুম চাষ পাহাড়ি আদিবাসী ও নৃ-গোষ্ঠীদের একটি ঐতিহ্য। জুম চাষের মাধ্যমে তারা
তাদের জীবন অতিবাহিত করে। কিন্তু জুম চাষ করার ক্ষতিকারক প্রভাব গুলো সম্পর্কে
এখনো আদিবাসীরা সতর্ক না। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ও পাহাড় ধ্বংসের অন্যতম কারণ
হোক হতে পারে জুম চাষ।
বাংলাদেশের বিভিন্ন পাহাড়ি অঞ্চল যেমন খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ইত্যাদি পার্বত্য
জেলায় বসবাসরত আদিবাসীরা জুম চাষ পাহাড় ধ্বংসের কারণ জেনেও তারা জুম চাষ
অব্যাহত রেখেছে। সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে এ সকল উপজাতির জুম চাষের নাম করে
পাহাড়ে আগুন জ্বালিয়ে নষ্ট করছে মূল্যবান গাছপালা।
তারা মনে করে ভালো ফসল ফলাতে হলে আগুন জ্বালাতে হবে। তাই শুষ্ক প্রকৃতিতে আগুন
জ্বালিয়ে গাছপালা পুড়িয়ে থাকে। আগুন জ্বালানোর কারনে সাথে সাথে বিশাল এক এলাকা
পুড়ে যায়। এই আগুন নিভানোর কোন ব্যবস্থাও নেই। এতে করে পুড়ে যাচ্ছে পাহাড়ের
অনেকটা অংশই।
ফলে বন্যপ্রাণী আবাসস্থল ও উপকারী কীটপতঙ্গ সব কমে হয়ে যাচ্ছে। পাহাড় ধ্বংস ও
নদীর গভীরতা কমে আসছে। এতে করে প্রকৃতি তার ভারসাম্য হারাচ্ছে। দীর্ঘদিন একই
স্থানে জুম চাষ করার ফলে তিন থেকে চার বছর সেখানে আর কোন শস্য উৎপাদন হয় না। ফলে
জমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে।
জুম চাষের কারণে পুরনো মূল্যবান বিভিন্ন গাছ যেমন -সেগুন, গর্জন, গামারি
,চাপালিস, ইত্যাদি পুড়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। জুম চাষের মাধ্যমে তারা বিভিন্ন
ক্ষতিকর তামাক চাষ করছে। খাগড়াছড়ি জেলায় প্রতিবছর পার্বত্য অঞ্চলের প্রায়
পঞ্চাশ হাজার একর জমিতে জুম চাষিরা অগ্নিসংযোগ করে জুম চাষের জন্য জমি প্রস্তুত
করছে।
এতে করে বিভিন্ন পার্বত্য অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে। তাই জুম চাষের
ক্ষতিকর প্রভাব আমাদের মারাত্মক সংকটের সামনে নিতে পারে।
সরকার জুম চাষকে নিরুৎসাহিত করেছেন কেন
জুম চাষের কারনে পরিবেশে বিভিন্ন বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। এজন্য সরকার জুম চাষকে
নিরু উৎসাহিত করেছেন। সরকারি নিষেধাজ্ঞা না মেনে এক শ্রেণীর উপজাতি জুম চাষ করার
নামে পাহাড়ে আগুন জ্বালিয়ে পুড়ে ফেলছে বিভিন্ন মূল্যবান গাছ।
জুম চাষে ভালো ফসল ফলাতে আগুন জ্বালাতে হবে এরকম ভুল ধারণা থাকার কারণে পাহাড়িরা
প্রতিবছর মার্চ এপ্রিল ও মে মাসে পাহাড়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। বৃহত্তম পার্বত্য
চট্টগ্রামে প্রতিবছর প্রায় ৫০ হাজার একর জমিতে জুম চাষ করা হয়ে থাকে।
জুম চাষ করার কারনে বর্ষার মৌসুমে ১০০ থেকে ২৫০ মেট্রিকটন মাটি ক্ষয় হয়ে যায়।
হয় হওয়া মাটি বৃষ্টির পানির সাথে মিশে বিভিন্ন ঝর্ণা ও ছড়া গড়িয়ে তার
বিস্তৃতি ঘটাচ্ছে। ফলে পার্বত্য নদ-নদী ও বৃহত্তম কাপ্তাই লেক পর্যন্ত গভীরতা কমে
আসছে।
মাইনি ,ফেনী ,মাতামুহুরী ,সাঙ্গু, কর্ণফুলী নদী ভরে গিয়ে নাব্যতা হারাচ্ছে। জুম
চাষের জন্য তারা পাহাড়ে পাহাড়ে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। যার কারনে বিভিন্ন
বন্যপ্রাণী তাদের আবাসস্থল হারাচ্ছে এবং তারা আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এ
সকল সমস্যা পরীক্ষা করে সরকার জুম চাষকে নিরুউৎসাহিত করেছে।
লেখকের মন্তব্য
জুম চাষ পাহাড়িদের জীবন চলাতে সহায়ক হলেও প্রকৃতি বিভিন্ন বিপর্যয় ডেকে আনছে।
তাই সকলের উচিত জুম চাষের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরা। তেমনি বাংলাদেশে বসবাসরত
আদিবাসীদের এর ক্ষতি সম্পর্কে ধারণা দেয়া।
জুম চাষ কি জুম চাষের পদ্ধতি ও জুম চাষের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জানাতে অবশ্যই
পোস্টটি শেয়ার করুন। পোস্টটি ভালো লাগলে লাইক ,কমেন্ট ও শেয়ার করে পাশে থাকুন।
আরো অনেক তথ্য পেতে www.twestinfo.com ফলো দিয়ে চোখ রাখুন।
টুইস্ট ইনফোর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন।প্রতিটি কমেন্টের উত্তর দেয়া হয়।
comment url